পৌষ মাসের দুপুরে মেঘের থাবায় আহত রোদে উঠোনে মোড়ায় বসে আরামে চোখ বুজে
আছে অখিল। খালি গা, লুঙ্গি পরা। গামছাখানা উরুর ওপর। তার মাথায়-পিঠে খাঁটি
সরিষার তেল মালিশ করে দিচ্ছে তেরো বছরের মেয়ে অর্পিতা। মধ্য চল্লিশের
অখিল গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন
। ছুটির দিনগুলোতে সে সাধারণত বাড়িতেই থাকে। আর দুপুরবেলা অর্পিতা বাবার মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করে দেয়। শরীরের বাকী অংশে অখিল নিজেই তেল মেখে মালিশ করে নেয়। হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম। বারো মাসই এই এক অভ্যাস অখিলের। আগে অখিলের মা শৈলবালা ছেলের মাথায় ও পিঠে তেল মালিশ করে দিতেন। শৈলবালার বয়স হয়েছে। হাতের জোরও কমেছে। তাই শৈলবালার জায়গায় এখন অর্পিতা। অবশ্য অর্পিতা মামাবাড়ি বা পিসি বাড়িতে বেড়াতে গেলে শৈলবালা এখনও তেলের বোতল নিয়ে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ান। অখিল বলে, ‘মা তুমি পারবে না। তোমার কষ্ট হবে। তুমি যাও।’
শৈলবালা চোখ বড় বড় করে অখিলের দিকে তাকান। অখিলের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে মুখে অ অ শব্দ করে নিজের ঠোঁটে আঙুল দেন। তারপর দু-হাত নেড়ে আরো কিছু অঙ্গভঙ্গি করেন। অখিল চুপ করে মাকে বোঝার চেষ্টা করে। মায়ের অঙ্গভঙ্গির অর্থ অখিলের কাছে পরিষ্কার,‘তুই চুপ কর। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই সেদিন অব্দি আমি তোর গায়ে তেল মালিশ করেছি। আর এখন মেয়েকে পেয়ে আমায় অথর্ব ভাবতে শুরু করেছিস।’
অখিল হাসে। মায়ের শীর্ণ হাত নিয়ে নিজের মাথায় বোলায়। শৈলবালাও তখন মুচকি হাসেন। তারপর ছেলের মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করেন।
শৈলবালা জন্ম থেকে বোবা। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ছোট এবং বোবা। দুইয়ে মিলে তিনি ছিলেন তাঁর বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। লোকে তাঁকে মাস্টার মশাই বলে ডাকতো। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু ছোট মেয়েটিকে নিয়ে মাস্টার মশাই ছিলেন খুবই চিন্তিত। মেয়ে বোবা হলেও দেখতে সুন্দরী। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। প্রায় কোমর সমান চুল। মায়ায় ভরা মুখখানা। এই মেয়েকে প্রথম দেখায় পাত্র তো বটেই পাত্রদের বাবাও চোখ ফেরাতে পারতো না। কিন্তু যখনই শুনতো মেয়ে বোবা। তখনই একটা চোরা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে পাত্র ভেগে পড়তো। আর পাত্রদের বাবা পালাতো ধুতির কোঁচা উচিয়ে। শেষে মাস্টার মশাই অবস্থাপন্ন ঘরে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা বাদ দিলেন। তিনি খুঁজতে লাগলেন গরিব ঘরের শিক্ষিত, ভদ্র পাত্র। কিন্তু তখনকার দিনে গরিব ঘরে ভদ্র ছেলের সন্ধান যথেষ্ট পাওয়া গেলেও, শিক্ষিত ছেলে সহজে মিলতো না। অনেক খুঁজে খুঁজে এক সময় সন্ধান পেলেন গরিব ঘরের এক বিধবার সদ্য বি, এ পাস ছেলে। নাম অভিলাষ। মা ছেলেতে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে খুব কষ্ট করে বি, এ পাস করেছে অভিলাষ। এখন চাকরি খুঁজছে। এমন সময়ই মাস্টার মশাই ছেলেটির সন্ধান পেলেন। কিন্তু সমস্যা হলো ছেলের চেহারার গড়ন খাঁটি বাংলা হলেও গায়ের রঙ আফ্রিকা থেকে আমদানী করা।
ছেলে এমন কালো বলে শুরুতে মাস্টার মশাইয়ের মন একটু খুঁত খুঁত করছিল। হোক বোবা, তবু তো মা দূর্গার মতো দেখতে তার শৈল। এমন মা দূর্গাকে অমন নিকষ কালো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের খুঁত খুঁত নিজেই উড়িয়ে দিলেন। হোক কালো ছেলে। মানুষের ভেতরটাই তো আসল। ভেতরটা ময়লা না হলেই হলো। ছেলে নম্র-ভদ্র স্বভাবের। শৈল মা তার সুখেই থাকবে ঐ ছেলের ঘরে। অভিলাষের বিধবা মায়ের কাছে মাস্টার মশাই প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। শুনে বিধবা আনন্দে কেঁদে কেঁটে অস্থির। রাজী না হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মায়ের আনন্দ দেখে অভিলাষও নিমরাজি হলো না।
মাস্টার মশাইয়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান শৈলবালা অভিলাষের ঘরে বউ হয়ে এলো। বিয়েতে অভিলাষের বাড়ির সমস্ত খরচ দিলেন মাস্টার মশাই। বাড়িতে টিনের ঘর তুলে দিলেন। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই উপর মহলে ধরাধরি করে পোস্ট অফিসের চাকরিও জুটিয়ে দিলেন জামাইকে। মাস্টার মশাইয়ের আদরের সন্তান আদরেই রইলো স্বামীর ঘরে।
অর্পিতা অখিলের চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে মালিশ করছে। ঘন, কোচের শলার মতো চুল অখিলের। চুলের ছাটটা পেয়েছে বাবার মতোই। বারান্দায় বসে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসেন শৈলবালা। তাঁর বালিকাবেলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনিও তাঁর বাবার মাথায় এমনিভাবে তেল মালিশ করে দিতেন। অখিলের স্বভাবটা হয়েছে শৈলবালার বাবার মতোই। গায়ের রঙটাও তাই। ফর্সা। শৈলবালার ভয় ছিল, তার সন্তানদের গায়ের রঙ যদি তার স্বামীর মতো হয়! তিন সন্তানের কেউ-ই অবশ্য তার স্বামীর গায়ের রঙ পায়নি। তিন সন্তানের মধ্যে অখিলই সবার বড়। এরপর দুটো মেয়ে। বড় মেয়ে শ্যামা একটু কালো। কিন্তু তার বাবার মতো নয়। ছোট মেয়ে দোলাও প্রায় ফর্সা। আর অখিল তো বলতে গেলে টকটকে ফর্সা।
অর্পিতা এখন অখিলের পিঠে তেল মালিশ করছে। লালচে রঙ ধারণ করেছে পিঠ। শৈলবালা অখিলের ফর্সা লালচে পিঠের দিকে তাকিয়ে হাসেন। ফিরে যান অনেক বছর আগে। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরের কথা। জোছনা রাত। গরমের দিন বলে দণি আর পুবের জানালা খোলা। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে হালকা বাতাসের ঢেউ ভাঙছে তার শরীরে। শৈলবালা শুয়েছে জানালার দিকে। জানালা দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়েছে তার শরীরে। বিছানায়। এমনকি পাশে ঘুমানো অভিলাষের গালেও। শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখা যায়। তাদের শোবার সময় চাঁদটা মাথার কাছে পুবের জানালায় উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেল শৈলবালার। পাশ ফিরে জানালার দিকে মুখ করে শুতেই নজরে পড়লো চাঁদটা দক্ষিণের জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে আলোর বন্যায়। সে চাঁদের আলোয় নিজের ডানহাতটা দেখতে থাকে। আবার চাঁদের দিকে তাকায়। টিনের চালে একটি জামগাছের পাতা পড়ে, গড়িয়ে নিচের দিকে নামার সর সর শব্দ হয়। আবার সব সুনসান। চাঁদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে সে। ভেঙচি কাঁটে। জিভ ভ্যাঙায় চাঁদকে। আঁচল দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে। বুকও ঢাকে। আবার আঁচলের বাইরে মুখ এনে মুচকি হাসে। হঠাৎ-ই একটি হাত। হাতটি শৈলবালার গলায় সুরসুরি দেয়। একটুও চমকায় না শৈলবালা। চেনা রোমশ হাতের চেনা গন্ধ! এ অভিলাষের মৌন আহব্বান। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চাঁদকে আড়াল করে অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। মাখানো অন্ধকার থেকে মুহূর্তের জন্য মুখ বাড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে প্রার্থনা করে চাঁদের কাছে, ‘আমার সন্তানের গায়ের রঙ যেন তোমার মতো ফুঁটফুঁটে হয়।’
শৈলবালার চাওয়া পূরণ হয়েছে। তার প্রথম সন্তান অখিল চাঁদের মতো ফুঁটফুঁটে না হোক টকটকে ফর্সাই হয়েছে।
শৈলবালা মৃদু হাসলেন। অর্পিতা এখন অখিলের মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। হঠাৎ অর্পিতা অখিলের চুলে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চিৎকার করে বললো, ‘বাবা তোমার চুল পেকে গেছে। তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বাবা। মা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
তারপর শৈলবালার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ঠাকুমা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
একটা পাকা চুল টেনে উঠিয়ে অখিলের সামনে ধরলো অর্পিতা, ‘এই দেখ।’
অখিল মেয়ের হাত থেকে পাকা চুলটা হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘চুল তো পাকবেই, আমার যে শ্বশুর হবার সময় হয়ে এলো।’
‘যাও!’
বলে আবার অখিলের মাথায় পাকা চুল খুঁজতে লাগলো অর্পিতা।
শৈলবালা আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন অর্পিতার দিকে। রেগে গেলে শৈলবালা এমন দৃষ্টিতে তাকান। বারান্দার খুঁটি খামচে ধরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আরেকবার অর্পিতার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
বিকেলে উঠোনের মরা রোদের মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছে অখিল। অখিলের স্ত্রী কল্পনা একটা ব্লাউজ আর সুই-সুতো হাতে ঘর থেকে বারান্দায় এসে বসলো। সবুজ ব্লাউজটার বগলের কাছটায় সেলাই খুলে গেছে। সেটাই সেলাই করতে বসলো সে।
শৈলবালা ঘর থেকে বের হয়ে অখিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুপুরের পর থেকে তিনি কারো সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করেননি। নিরিবিলি নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। এখন ছেলের পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলেন। হয়তো খুঁজছেন পাকা চুল।
‘কিরে মা?’ অখিল মাকে তুই বলতেই অভ্যস্ত।
শৈলবালা একই ভাবে অখিলের মাথার চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। কয়েকটা পাকা চুল চোখে পড়লো। চোখে জল এসে গেল শৈলবালার। ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। কল্পনা ব্লাউজ সেলাই করতে করতে শ্বাশুরি আর স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিল আর মৃদু হাসছিল। হঠাৎ শ্বাশুরির ফুঁপিয়ে ওঠা দেখে সে চিন্তিত মুখে তাকালো। অখিলও তাকালো মায়ের দিকে।
শৈলবালা আবার ঘরে চলে যাচ্ছিল, তার চোখে পড়লো উঠোনের তারে মেলে দেওয়া শুকনো কাপড় অর্পিতা তুলে নিচ্ছে। অর্পিতা শৈলবালার সাদা থানে হাত দিতেই যেন বদলে গেল শৈলবালা। প্রি গতিতে মুহূর্তের মধ্যে অর্পিতার কাছে গিয়ে তার হাত থেকে নিজের কাপড়টা কেড়ে নিল। রেগে অ আ করতে করতে দু-হাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝালো, ‘তুই আর আমার কোন কাজ করবি না।’ অখিল আর কল্পনা অবাক হয়ে শৈলবালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হতভম্ব অর্পিতা বললো, ‘আমি আবার কি করলাম?’
শৈলবালা মুখে শব্দ করে, হাত নেড়ে মনের ভাব বোঝালেন। তিনি বুকে ডান হাত ঠুকে অতঃপর দু-হাত দিয়ে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মতো ভঙ্গি করলেন। অখিলের জন্মের পর থেকেই অখিলকে বোঝাতে তিনি এমন অঙ্গভঙ্গি করেন। এখনও করলেন। সেই সঙ্গে বোঝাতে চাইলেন আরো অনেক কিছু। যার অর্থ দাঁড়ালো এই যে, ‘তুই আমার কোন কাজ করবি না। আমার সাথে কথাও বলবি না। দুপুরে তুই আমার ছেলেকে বুড়ো বলেছিস।’
কল্পনার ব্লাউজ সেলাই শেষ। দাঁতে সুতো কেঁটে মৃদু হাসলো সে। অখিলও মায়ের পাগলামী দেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শৈলবালা নিজের ঘরে ঢুকলো। কাপড়খানা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় বসে কেঁদে ফেললো।
কিছুণ পর মায়ের ঘরে এলো অখিল। মায়ের পাশে বসে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ‘আমাকে বুড়ো বলায় তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস, নারে মা? অর্পিতা তো মজা করে আমাকে বুড়ো বলেছে। ও বললেই হলো নাকি! বয়সের নিয়মে না হয় দুটো-চারটে চুল পেকে গেছে। কিন্তু আমি এখনও তোর সেই ছোট্ট অখিলই আছি। তোর কাছে আমি ছোট-ই থাকতে চাই।’
অখিল মায়ের কোলে মাথা রাখলো। শৈলবালা অখিলের গায়ে, মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন। অখিলও ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। শৈলবালা ফিরে গেল অনেক বছর আগে। পুরনো স্মৃতিতে মনের চোখ বোলালো। ছোট্টবেলার অখিল ফিরে এলো মায়ের কাছে। হাঁটি হাঁটি পা পা অখিল, কৈশোরের দূরন্ত অখিল, যৌবনের পিতৃহীন দিশেহারা গম্ভীর অখিল। বিভিন্ন বয়সের অখিলরা মায়ের স্মৃতির সাথে লুকোচুরি খেলতে লাগলো। অখিলদের সাথে শৈলবালার এই লুকোচুরি খেলা নতুন নয়। শৈলবালা প্রায়ই খেলেন একা একা। কেউ জানতেও পারে না। এমনকি অখিলও না। শৈলবালার সত্ত্বার সবটা জুড়ে আছে অখিল। অখিলের বাবা চলে গেছেন। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সেই। তখন এই অখিল-ই ছিল তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। অখিলকে আঁকড়ে ধরেই তিনি জীবনের ভাটিতে ভেসে এসেছেন। তাই অখিলকে না দেখে তিনি একটি রাতও শান্তিতে ঘুমুতে যেতে পারেন না। আগে অখিল দু-একদিনের জন্য শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে, তিনি যাবার সময় কাঁদতেন। কল্পনা এসব দেখে প্রথম প্রথম শাশুড়ির প্রতি খুব বিরক্ত হতো। পরে যখন সে শাশুড়িকে বুঝতে শিখেছে, শাশুড়ির ভেতরটা পড়তে পেরেছে, তখন সেও শাশুড়িকে ভালবাসতে শুরু করেছে নিজের মায়ের মতো করে। মায়ের জন্য অখিল কোথাও গিয়ে রাত থাকে না। দরকারি কাজে কোথাও গেলে যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে আসে। পাড়ার লোকে বলে আদিখ্যেতা। গায়ে মাখে না শৈলবালা, অখিলও না। এই আদিখ্যেতাটুকু নিয়েই মা-ছেলে নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে চায় আরো অনেকগুলো বছর।
স্মৃতির লুকোচুরি খেলা থেকে বেড়িয়ে এসে শৈলবালা মৃদু হাসলেন। অখিলের কপালে চুমু খেলেন। অখিল মায়ের হাতখানা নিয়ে নিজের ডান গালে রাখলো। তার চোখে চিক চিক করে উঠলো জল।
অর্পিতা শৈলবালার কাছে শোয়। রাতে শুয়ে কপট অভিমানে শৈলবালা অর্পিতার দিকে পিছন ফিরে রইলো। অর্পিতা পিছন থেকে শৈলবালার গলার ওপর হাত দিয়ে বললো, ‘ও ঠাকুমা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বাবাকে আর কখনও বুড়ো বলবো না। বাবা এখনও তোমার ছোট্ট খোকা। ঘুরে শোও ঠাকুমা। আর রাগ করে থেকো না।’
শৈলবালা পাশ ফিরলেন। অর্পিতার দিকে তাকিয়ে দুহাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝালেন যে, ‘তুই আমার ছেলেকে আর বুড়ো বলবি না তো?’
অর্পিতা ঘাড় নেড়ে বললো, ‘বলবো না। আর কনো তোমার ছেলেকে বুড়ো বলবো না।’
শৈলবালা হাসলেন। হেসে অর্পিতার গলা জড়িয়ে ধরলেন।
কবে শৈলবালার চুলে পাক ধরেছে, খেয়াল নেই তার। একটা দুইটা করে পাকতে পাকতে মাথার আশি ভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। তাও কখনো মন খারাপ হয়নি তার। বরাবরের মতোই চুলে তেল মেখে পুকুর ঘাটে গেছেন, চুল খুলে স্নান করেছেন, খোঁপায় গামছা বেঁধে ঘরে এসে চুল আঁচড়েছেন। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার জন্য, সাদা চুলের জন্য কখনও তার বুক চিড়ে দীর্ঘঃশ্বাস বের হয়নি। মন খারাপ হয়নি। অথচ আজ সন্তানের মাথার পাকা চুলের জন্য তার চোখের জল পর্যন্ত ঝরলো। এই বুঝি মায়ের মন। মা।
কিছুদিন বাদে বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকগণ শতভাগ বেতন-ভাতার দাবীতে অনশন কর্মসূচী পালন শুরু করলেন। অখিল যোগ দিল সেই অনশনে। অনশনের দ্বিতীয় দিনেই সরকারী দলের পান্ডারা শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচীতে হামলা চালালো। নিরীহ-নিরস্ত্র শিক্ষকেরা এলোপাথারি মার খেল। কারো মাথা ফাঁটলো, কারো হাত ভাঙলো, কারো বা পা। কয়েকজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তাঁদের মধ্যে একজন অখিল। অখিল মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অচেতন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে।
বাড়িতে খবর এলো কল্পনার কাছে। কল্পনা ছুটে গেল হাসপাতালে। শৈলবালাকে মিথ্যে বলে গেল, ‘আমার দাদার খুব অসুখ। আমি আর আপনার ছেলে দাদাকে দেখতে যাচ্ছি। আজ নাও ফিরতে পারি।’
পরদিন সকালে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো বাড়ির উঠোনে। তুলসী তলায় নামানো হলো অখিলকে। শৈলবালা সারারাত ছটফট করেছেন ছেলের জন্য। ছেলের চিন্তায় ঘুম আসেনি চোখে। সূর্য ওঠার পর থেকে তিনি অপোয় ছিলেন কখন সাইকেলের বেল বাজবে। কখন এসে মা বলে ডাকবে অখিল আর তিনি ছুটে যাবেন অখিলের কাছে!
শৈলবালার অপোর প্রহর শেষ। অখিল এসেছে। তিনি অখিলের কাছে ছুটে গেলেন না। চারিদিকে কাঁন্নার রোল-কল্পনার, অর্পিতার, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের। অথচ বারান্দায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে আছেন শৈলবালা। ঐ তো অখিল আসছে। টাল খাওয়া পায়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছোট্ট অখিল তার দিকে ছুটে আসছে। পড়ে যাচ্ছে। উঠে আবার দৌড়চ্ছে। তার পিছনে আরো অখিল। বাল্যকালের অখিল, কৈশোরের অখিল, যৌবনের অখিল। কত অখিল!
। ছুটির দিনগুলোতে সে সাধারণত বাড়িতেই থাকে। আর দুপুরবেলা অর্পিতা বাবার মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করে দেয়। শরীরের বাকী অংশে অখিল নিজেই তেল মেখে মালিশ করে নেয়। হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম। বারো মাসই এই এক অভ্যাস অখিলের। আগে অখিলের মা শৈলবালা ছেলের মাথায় ও পিঠে তেল মালিশ করে দিতেন। শৈলবালার বয়স হয়েছে। হাতের জোরও কমেছে। তাই শৈলবালার জায়গায় এখন অর্পিতা। অবশ্য অর্পিতা মামাবাড়ি বা পিসি বাড়িতে বেড়াতে গেলে শৈলবালা এখনও তেলের বোতল নিয়ে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ান। অখিল বলে, ‘মা তুমি পারবে না। তোমার কষ্ট হবে। তুমি যাও।’
শৈলবালা চোখ বড় বড় করে অখিলের দিকে তাকান। অখিলের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে মুখে অ অ শব্দ করে নিজের ঠোঁটে আঙুল দেন। তারপর দু-হাত নেড়ে আরো কিছু অঙ্গভঙ্গি করেন। অখিল চুপ করে মাকে বোঝার চেষ্টা করে। মায়ের অঙ্গভঙ্গির অর্থ অখিলের কাছে পরিষ্কার,‘তুই চুপ কর। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই সেদিন অব্দি আমি তোর গায়ে তেল মালিশ করেছি। আর এখন মেয়েকে পেয়ে আমায় অথর্ব ভাবতে শুরু করেছিস।’
অখিল হাসে। মায়ের শীর্ণ হাত নিয়ে নিজের মাথায় বোলায়। শৈলবালাও তখন মুচকি হাসেন। তারপর ছেলের মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করেন।
শৈলবালা জন্ম থেকে বোবা। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ছোট এবং বোবা। দুইয়ে মিলে তিনি ছিলেন তাঁর বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। লোকে তাঁকে মাস্টার মশাই বলে ডাকতো। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু ছোট মেয়েটিকে নিয়ে মাস্টার মশাই ছিলেন খুবই চিন্তিত। মেয়ে বোবা হলেও দেখতে সুন্দরী। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। প্রায় কোমর সমান চুল। মায়ায় ভরা মুখখানা। এই মেয়েকে প্রথম দেখায় পাত্র তো বটেই পাত্রদের বাবাও চোখ ফেরাতে পারতো না। কিন্তু যখনই শুনতো মেয়ে বোবা। তখনই একটা চোরা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে পাত্র ভেগে পড়তো। আর পাত্রদের বাবা পালাতো ধুতির কোঁচা উচিয়ে। শেষে মাস্টার মশাই অবস্থাপন্ন ঘরে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা বাদ দিলেন। তিনি খুঁজতে লাগলেন গরিব ঘরের শিক্ষিত, ভদ্র পাত্র। কিন্তু তখনকার দিনে গরিব ঘরে ভদ্র ছেলের সন্ধান যথেষ্ট পাওয়া গেলেও, শিক্ষিত ছেলে সহজে মিলতো না। অনেক খুঁজে খুঁজে এক সময় সন্ধান পেলেন গরিব ঘরের এক বিধবার সদ্য বি, এ পাস ছেলে। নাম অভিলাষ। মা ছেলেতে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে খুব কষ্ট করে বি, এ পাস করেছে অভিলাষ। এখন চাকরি খুঁজছে। এমন সময়ই মাস্টার মশাই ছেলেটির সন্ধান পেলেন। কিন্তু সমস্যা হলো ছেলের চেহারার গড়ন খাঁটি বাংলা হলেও গায়ের রঙ আফ্রিকা থেকে আমদানী করা।
ছেলে এমন কালো বলে শুরুতে মাস্টার মশাইয়ের মন একটু খুঁত খুঁত করছিল। হোক বোবা, তবু তো মা দূর্গার মতো দেখতে তার শৈল। এমন মা দূর্গাকে অমন নিকষ কালো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের খুঁত খুঁত নিজেই উড়িয়ে দিলেন। হোক কালো ছেলে। মানুষের ভেতরটাই তো আসল। ভেতরটা ময়লা না হলেই হলো। ছেলে নম্র-ভদ্র স্বভাবের। শৈল মা তার সুখেই থাকবে ঐ ছেলের ঘরে। অভিলাষের বিধবা মায়ের কাছে মাস্টার মশাই প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। শুনে বিধবা আনন্দে কেঁদে কেঁটে অস্থির। রাজী না হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মায়ের আনন্দ দেখে অভিলাষও নিমরাজি হলো না।
মাস্টার মশাইয়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান শৈলবালা অভিলাষের ঘরে বউ হয়ে এলো। বিয়েতে অভিলাষের বাড়ির সমস্ত খরচ দিলেন মাস্টার মশাই। বাড়িতে টিনের ঘর তুলে দিলেন। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই উপর মহলে ধরাধরি করে পোস্ট অফিসের চাকরিও জুটিয়ে দিলেন জামাইকে। মাস্টার মশাইয়ের আদরের সন্তান আদরেই রইলো স্বামীর ঘরে।
অর্পিতা অখিলের চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে মালিশ করছে। ঘন, কোচের শলার মতো চুল অখিলের। চুলের ছাটটা পেয়েছে বাবার মতোই। বারান্দায় বসে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসেন শৈলবালা। তাঁর বালিকাবেলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনিও তাঁর বাবার মাথায় এমনিভাবে তেল মালিশ করে দিতেন। অখিলের স্বভাবটা হয়েছে শৈলবালার বাবার মতোই। গায়ের রঙটাও তাই। ফর্সা। শৈলবালার ভয় ছিল, তার সন্তানদের গায়ের রঙ যদি তার স্বামীর মতো হয়! তিন সন্তানের কেউ-ই অবশ্য তার স্বামীর গায়ের রঙ পায়নি। তিন সন্তানের মধ্যে অখিলই সবার বড়। এরপর দুটো মেয়ে। বড় মেয়ে শ্যামা একটু কালো। কিন্তু তার বাবার মতো নয়। ছোট মেয়ে দোলাও প্রায় ফর্সা। আর অখিল তো বলতে গেলে টকটকে ফর্সা।
অর্পিতা এখন অখিলের পিঠে তেল মালিশ করছে। লালচে রঙ ধারণ করেছে পিঠ। শৈলবালা অখিলের ফর্সা লালচে পিঠের দিকে তাকিয়ে হাসেন। ফিরে যান অনেক বছর আগে। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরের কথা। জোছনা রাত। গরমের দিন বলে দণি আর পুবের জানালা খোলা। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে হালকা বাতাসের ঢেউ ভাঙছে তার শরীরে। শৈলবালা শুয়েছে জানালার দিকে। জানালা দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়েছে তার শরীরে। বিছানায়। এমনকি পাশে ঘুমানো অভিলাষের গালেও। শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখা যায়। তাদের শোবার সময় চাঁদটা মাথার কাছে পুবের জানালায় উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেল শৈলবালার। পাশ ফিরে জানালার দিকে মুখ করে শুতেই নজরে পড়লো চাঁদটা দক্ষিণের জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে আলোর বন্যায়। সে চাঁদের আলোয় নিজের ডানহাতটা দেখতে থাকে। আবার চাঁদের দিকে তাকায়। টিনের চালে একটি জামগাছের পাতা পড়ে, গড়িয়ে নিচের দিকে নামার সর সর শব্দ হয়। আবার সব সুনসান। চাঁদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে সে। ভেঙচি কাঁটে। জিভ ভ্যাঙায় চাঁদকে। আঁচল দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে। বুকও ঢাকে। আবার আঁচলের বাইরে মুখ এনে মুচকি হাসে। হঠাৎ-ই একটি হাত। হাতটি শৈলবালার গলায় সুরসুরি দেয়। একটুও চমকায় না শৈলবালা। চেনা রোমশ হাতের চেনা গন্ধ! এ অভিলাষের মৌন আহব্বান। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চাঁদকে আড়াল করে অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। মাখানো অন্ধকার থেকে মুহূর্তের জন্য মুখ বাড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে প্রার্থনা করে চাঁদের কাছে, ‘আমার সন্তানের গায়ের রঙ যেন তোমার মতো ফুঁটফুঁটে হয়।’
শৈলবালার চাওয়া পূরণ হয়েছে। তার প্রথম সন্তান অখিল চাঁদের মতো ফুঁটফুঁটে না হোক টকটকে ফর্সাই হয়েছে।
শৈলবালা মৃদু হাসলেন। অর্পিতা এখন অখিলের মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। হঠাৎ অর্পিতা অখিলের চুলে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চিৎকার করে বললো, ‘বাবা তোমার চুল পেকে গেছে। তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বাবা। মা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
তারপর শৈলবালার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ঠাকুমা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
একটা পাকা চুল টেনে উঠিয়ে অখিলের সামনে ধরলো অর্পিতা, ‘এই দেখ।’
অখিল মেয়ের হাত থেকে পাকা চুলটা হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘চুল তো পাকবেই, আমার যে শ্বশুর হবার সময় হয়ে এলো।’
‘যাও!’
বলে আবার অখিলের মাথায় পাকা চুল খুঁজতে লাগলো অর্পিতা।
শৈলবালা আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন অর্পিতার দিকে। রেগে গেলে শৈলবালা এমন দৃষ্টিতে তাকান। বারান্দার খুঁটি খামচে ধরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আরেকবার অর্পিতার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
বিকেলে উঠোনের মরা রোদের মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছে অখিল। অখিলের স্ত্রী কল্পনা একটা ব্লাউজ আর সুই-সুতো হাতে ঘর থেকে বারান্দায় এসে বসলো। সবুজ ব্লাউজটার বগলের কাছটায় সেলাই খুলে গেছে। সেটাই সেলাই করতে বসলো সে।
শৈলবালা ঘর থেকে বের হয়ে অখিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুপুরের পর থেকে তিনি কারো সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করেননি। নিরিবিলি নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। এখন ছেলের পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলেন। হয়তো খুঁজছেন পাকা চুল।
‘কিরে মা?’ অখিল মাকে তুই বলতেই অভ্যস্ত।
শৈলবালা একই ভাবে অখিলের মাথার চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। কয়েকটা পাকা চুল চোখে পড়লো। চোখে জল এসে গেল শৈলবালার। ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। কল্পনা ব্লাউজ সেলাই করতে করতে শ্বাশুরি আর স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিল আর মৃদু হাসছিল। হঠাৎ শ্বাশুরির ফুঁপিয়ে ওঠা দেখে সে চিন্তিত মুখে তাকালো। অখিলও তাকালো মায়ের দিকে।
শৈলবালা আবার ঘরে চলে যাচ্ছিল, তার চোখে পড়লো উঠোনের তারে মেলে দেওয়া শুকনো কাপড় অর্পিতা তুলে নিচ্ছে। অর্পিতা শৈলবালার সাদা থানে হাত দিতেই যেন বদলে গেল শৈলবালা। প্রি গতিতে মুহূর্তের মধ্যে অর্পিতার কাছে গিয়ে তার হাত থেকে নিজের কাপড়টা কেড়ে নিল। রেগে অ আ করতে করতে দু-হাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝালো, ‘তুই আর আমার কোন কাজ করবি না।’ অখিল আর কল্পনা অবাক হয়ে শৈলবালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হতভম্ব অর্পিতা বললো, ‘আমি আবার কি করলাম?’
শৈলবালা মুখে শব্দ করে, হাত নেড়ে মনের ভাব বোঝালেন। তিনি বুকে ডান হাত ঠুকে অতঃপর দু-হাত দিয়ে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মতো ভঙ্গি করলেন। অখিলের জন্মের পর থেকেই অখিলকে বোঝাতে তিনি এমন অঙ্গভঙ্গি করেন। এখনও করলেন। সেই সঙ্গে বোঝাতে চাইলেন আরো অনেক কিছু। যার অর্থ দাঁড়ালো এই যে, ‘তুই আমার কোন কাজ করবি না। আমার সাথে কথাও বলবি না। দুপুরে তুই আমার ছেলেকে বুড়ো বলেছিস।’
কল্পনার ব্লাউজ সেলাই শেষ। দাঁতে সুতো কেঁটে মৃদু হাসলো সে। অখিলও মায়ের পাগলামী দেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শৈলবালা নিজের ঘরে ঢুকলো। কাপড়খানা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় বসে কেঁদে ফেললো।
কিছুণ পর মায়ের ঘরে এলো অখিল। মায়ের পাশে বসে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ‘আমাকে বুড়ো বলায় তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস, নারে মা? অর্পিতা তো মজা করে আমাকে বুড়ো বলেছে। ও বললেই হলো নাকি! বয়সের নিয়মে না হয় দুটো-চারটে চুল পেকে গেছে। কিন্তু আমি এখনও তোর সেই ছোট্ট অখিলই আছি। তোর কাছে আমি ছোট-ই থাকতে চাই।’
অখিল মায়ের কোলে মাথা রাখলো। শৈলবালা অখিলের গায়ে, মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন। অখিলও ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। শৈলবালা ফিরে গেল অনেক বছর আগে। পুরনো স্মৃতিতে মনের চোখ বোলালো। ছোট্টবেলার অখিল ফিরে এলো মায়ের কাছে। হাঁটি হাঁটি পা পা অখিল, কৈশোরের দূরন্ত অখিল, যৌবনের পিতৃহীন দিশেহারা গম্ভীর অখিল। বিভিন্ন বয়সের অখিলরা মায়ের স্মৃতির সাথে লুকোচুরি খেলতে লাগলো। অখিলদের সাথে শৈলবালার এই লুকোচুরি খেলা নতুন নয়। শৈলবালা প্রায়ই খেলেন একা একা। কেউ জানতেও পারে না। এমনকি অখিলও না। শৈলবালার সত্ত্বার সবটা জুড়ে আছে অখিল। অখিলের বাবা চলে গেছেন। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সেই। তখন এই অখিল-ই ছিল তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। অখিলকে আঁকড়ে ধরেই তিনি জীবনের ভাটিতে ভেসে এসেছেন। তাই অখিলকে না দেখে তিনি একটি রাতও শান্তিতে ঘুমুতে যেতে পারেন না। আগে অখিল দু-একদিনের জন্য শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে, তিনি যাবার সময় কাঁদতেন। কল্পনা এসব দেখে প্রথম প্রথম শাশুড়ির প্রতি খুব বিরক্ত হতো। পরে যখন সে শাশুড়িকে বুঝতে শিখেছে, শাশুড়ির ভেতরটা পড়তে পেরেছে, তখন সেও শাশুড়িকে ভালবাসতে শুরু করেছে নিজের মায়ের মতো করে। মায়ের জন্য অখিল কোথাও গিয়ে রাত থাকে না। দরকারি কাজে কোথাও গেলে যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে আসে। পাড়ার লোকে বলে আদিখ্যেতা। গায়ে মাখে না শৈলবালা, অখিলও না। এই আদিখ্যেতাটুকু নিয়েই মা-ছেলে নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে চায় আরো অনেকগুলো বছর।
স্মৃতির লুকোচুরি খেলা থেকে বেড়িয়ে এসে শৈলবালা মৃদু হাসলেন। অখিলের কপালে চুমু খেলেন। অখিল মায়ের হাতখানা নিয়ে নিজের ডান গালে রাখলো। তার চোখে চিক চিক করে উঠলো জল।
অর্পিতা শৈলবালার কাছে শোয়। রাতে শুয়ে কপট অভিমানে শৈলবালা অর্পিতার দিকে পিছন ফিরে রইলো। অর্পিতা পিছন থেকে শৈলবালার গলার ওপর হাত দিয়ে বললো, ‘ও ঠাকুমা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বাবাকে আর কখনও বুড়ো বলবো না। বাবা এখনও তোমার ছোট্ট খোকা। ঘুরে শোও ঠাকুমা। আর রাগ করে থেকো না।’
শৈলবালা পাশ ফিরলেন। অর্পিতার দিকে তাকিয়ে দুহাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝালেন যে, ‘তুই আমার ছেলেকে আর বুড়ো বলবি না তো?’
অর্পিতা ঘাড় নেড়ে বললো, ‘বলবো না। আর কনো তোমার ছেলেকে বুড়ো বলবো না।’
শৈলবালা হাসলেন। হেসে অর্পিতার গলা জড়িয়ে ধরলেন।
কবে শৈলবালার চুলে পাক ধরেছে, খেয়াল নেই তার। একটা দুইটা করে পাকতে পাকতে মাথার আশি ভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। তাও কখনো মন খারাপ হয়নি তার। বরাবরের মতোই চুলে তেল মেখে পুকুর ঘাটে গেছেন, চুল খুলে স্নান করেছেন, খোঁপায় গামছা বেঁধে ঘরে এসে চুল আঁচড়েছেন। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার জন্য, সাদা চুলের জন্য কখনও তার বুক চিড়ে দীর্ঘঃশ্বাস বের হয়নি। মন খারাপ হয়নি। অথচ আজ সন্তানের মাথার পাকা চুলের জন্য তার চোখের জল পর্যন্ত ঝরলো। এই বুঝি মায়ের মন। মা।
কিছুদিন বাদে বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকগণ শতভাগ বেতন-ভাতার দাবীতে অনশন কর্মসূচী পালন শুরু করলেন। অখিল যোগ দিল সেই অনশনে। অনশনের দ্বিতীয় দিনেই সরকারী দলের পান্ডারা শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচীতে হামলা চালালো। নিরীহ-নিরস্ত্র শিক্ষকেরা এলোপাথারি মার খেল। কারো মাথা ফাঁটলো, কারো হাত ভাঙলো, কারো বা পা। কয়েকজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তাঁদের মধ্যে একজন অখিল। অখিল মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অচেতন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে।
বাড়িতে খবর এলো কল্পনার কাছে। কল্পনা ছুটে গেল হাসপাতালে। শৈলবালাকে মিথ্যে বলে গেল, ‘আমার দাদার খুব অসুখ। আমি আর আপনার ছেলে দাদাকে দেখতে যাচ্ছি। আজ নাও ফিরতে পারি।’
পরদিন সকালে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো বাড়ির উঠোনে। তুলসী তলায় নামানো হলো অখিলকে। শৈলবালা সারারাত ছটফট করেছেন ছেলের জন্য। ছেলের চিন্তায় ঘুম আসেনি চোখে। সূর্য ওঠার পর থেকে তিনি অপোয় ছিলেন কখন সাইকেলের বেল বাজবে। কখন এসে মা বলে ডাকবে অখিল আর তিনি ছুটে যাবেন অখিলের কাছে!
শৈলবালার অপোর প্রহর শেষ। অখিল এসেছে। তিনি অখিলের কাছে ছুটে গেলেন না। চারিদিকে কাঁন্নার রোল-কল্পনার, অর্পিতার, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের। অথচ বারান্দায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে আছেন শৈলবালা। ঐ তো অখিল আসছে। টাল খাওয়া পায়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছোট্ট অখিল তার দিকে ছুটে আসছে। পড়ে যাচ্ছে। উঠে আবার দৌড়চ্ছে। তার পিছনে আরো অখিল। বাল্যকালের অখিল, কৈশোরের অখিল, যৌবনের অখিল। কত অখিল!
No comments:
Post a Comment